নীলফামারী জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য
জেলা পরিচিতি (পর্ব-৫): নীলফামারী
নীলফামারী, নীলের দেশ হিসাবে পরিচিত, বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত, রংপুর বিভাগের সীমান্তঘেষা একটি জেলা।
এ জেলার ব্র্যান্ডিং স্লোগান হলো: উত্তরের শিল্পনগরী, দীপ্তিমান নীলফামারী
নামকরণ ও ইতিহাস
নীলফামারী জেলার নামকরন সম্পর্কে যতদূর জানা যায় তা হলো: দুই শতাধিক বছর পূর্বে এ অঞ্চলের উর্বর ভূমি নীল চাষের অনুকূল হওয়ায় ইংরেজ নীলকরেরা দেশের অন্যান্য এলাকার তুলনায় নীলফামারীতে বেশি সংখ্যায় নীলকুঠি ও নীল খামার গড়ে তোলে।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতেই দুরাকুটি, ডিমলা, কিশোরগঞ্জ উপজেলা, টেঙ্গনমারী প্রভৃতি স্থানে নীলকুঠি স্থাপিত হয়। ধারণা করা হয়, স্থানীয় কৃষকদের মুখে ‘নীল খামার’ রূপান্তরিত হয় ‘নীল খামারী’তে। আর এই নীলখামারীর অপভ্রংশ হিসেবে উদ্ভব হয় নীলফামারী নামের।
ভৌগলিক অবস্থান
এ জেলার পূর্বে রংপুর জেলা ও লালমনিরহাট জেলা, দক্ষিণে রংপুর জেলা ও দিনাজপুর জেলা, পশ্চিমে দিনাজপুর জেলার খানসামা উপজেলা ও পঞ্চগড় জেলা এবং উত্তরে ভারতের জলপাইগুড়ি জেলা অবস্থিত।
নীলফামারী জেলার আয়তন প্রায় ১৫৮০.৮৫ বর্গ কিলোমিটার এবং গুগল ম্যাপ অনুযায়ী রাজধানী ঢাকা থেকে এ জেলার দূরত্ব প্রায় ৩৪৭ কিঃমিঃ।
এ জেলায় প্রধান যেসকল নদী রয়েছে তার মধ্যে আছে: তিস্তা, যমুনেশ্বরী, বুড়ি তিস্তা, ঘাঘট ইত্যাদি।
প্রাতিষ্ঠানিক গঠন-কাঠামো
নীলফামারী ১৮৭৫ সালে মহকুমা গঠিত হয় এবং মহকুমাকে জেলায় রূপান্তর করা হয় ১৯৮৪ সালে। নীলফামারী জেলার ৪টি পৌরসভা, ৬টি উপজেলা এবং ১২-১৫ পর্যন্ত মোট ৪টি সংসদীয় আসন রয়েছে।
এ জেলার উপজেলাগুলো হলো:
- কিশোরগঞ্জ
- জলঢাকা
- ডিমলা
- ডোমার
- নীলফামারী সদর
- সৈয়দপুর উপজেলা।
এখানে একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য যে জেলার ছয়টি উপজেলার মধ্যে নীলফামারী সদর উপজেলা সর্ববৃহৎ (৩৭৩.০৯ বর্গ কিমি) এবং সবচেয়ে ছোট উপজেলা সৈয়দপুর (১২১.৬৮ বর্গ কিমি)।
সংস্কৃতি ও বিনোদন
নীলফামারী জেলায় সত্যপীরের গান, হাঁস খেলা, মাছ খেলাসহ অনেক উৎসব ও মেলার আয়োজন হয়।
নীলফামারী জেলায় ভাওয়াইয়া গানের বিশেষ প্রচলন রয়েছে। প্রচলিত গানগুলো মুলত কাহিনী প্রধান। বিষহরি বা মনসার গান, হুদুমদেওর গান, মহররমের জারি, বিয়ের গান বা হেরোয়া, ভাসান যাত্রা, সত্যপীরের গান ইত্যাদি এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
নয়নশরি-বোষ্টম বাউদিয়া, শীতল শরি-জানকপালা, অম্বলশরি-পিছল বাউদিয়া, পয়মাল শরি-ভোদাইমেম্বার প্রভৃতি ‘শরির গান’ বেশ জনপ্রিয়। তিনদিন থেকে ছয় দিনের নবজাতককে ঘিরে আত্মীয়-স্বজন পাড়া প্রতিবেশীরা ‘পাসটি’ নামের একটি উৎসবের আয়োজন করে থাকে।
এছাড়া এ জেলায় অষ্টমঙ্গলা, ভাদরকাটানী, পৌষকাটানী প্রভৃতি সামাজিক-সাংস্কৃতিক আচার-অনুষ্ঠানের প্রচলন রয়েছে।
এ জেলা থেকে বিভিন্ন ধরনের দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হয় যার মধ্যে আছে- দৈনিকঃ নীল কথা সাপ্তাহিকঃ নীলফামারী বার্তা, নীলসাগর, নীলসমাচার, জলঢাকা ইত্যাদি।
কৃষি ব্যবস্থা
নীলফামারী জেলার ৬৮.৫% মানুষ কৃষির উপর নির্ভরশীল। এ জেলার অন্যতম প্রধান অর্থকরী ফসল হলো ভুট্টা ও মরিচ। এছাড়াও আলু, ধান, গম, সরিষা, পাট, তামাক প্রচুর পরিমাণে উৎপাদিত হয়।
এখানকার প্রধান শিল্প বয়ন, চাল, বাশবেত প্রভৃতি। দারোয়ানী বস্ত্র কল এ জেলার সর্ববৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান। এছাড়াও উত্তরা ইপিজেড ও সৈয়দপুর বিসিক শিল্প নগরীর মত শিল্প পার্ক এ জেলাতে রয়েছে।
শিক্ষা ব্যবস্থা
২০২২ সালের জনশুমারী ও গৃহগণনা প্রতিবেদন অনুযায়ী এ জেলার জনসংখ্যা ২০,৯২,৫৬২ জন এবং শিক্ষার হার ৬৯.১৩%.
এ জেলার কিছু উল্লেখযোগ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে:
- নীলফামারী মেডিকেল কলেজ
- বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সৈয়দপুর
- নীলফামারী সরকারি কলেজ, নীলফামারী
- নীলফামারী সরকারি মহিলা কলেজ
- ডোমার সরকারি কলেজ, ডোমার
- সৈয়দপুর সরকারি কলেজ
- সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড হাই স্কুল
- ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ, সৈয়দপুর
- নীলফামারী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়
- নীলফামারী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়
- ডোমার বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়
- ডিমলা রাণী বৃন্দারাণী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়
- কালেক্টরেট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ, নীলফামারী
গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও দর্শনীয় স্থান
- বিন্যাদিঘী বা বিরাট রাজার দিঘি - যা বর্তমান নীলসাগর নামে পরিচিত
- ধর্মপালের গড়
- তিস্তা ব্যারেজ ও সেচ প্রকল্প
- কুন্দুপুকুর মাজার
- হযরত শাহ কলন্দর মাজার
- হরিশচন্দ্রের পাঠ
- ময়নামতির দূর্গ
- ভীমের মায়ের চুলা
- চীনা মসজিদ
- সৈয়দপুর চার্চ
- সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানা
- দারোয়ানী টেক্সটাইল মিল
- উত্তরা ইপিজেড
- সৈয়দপুর বিমানবন্দর
- ডিমলা রাজবাড়ী
- বালাপাড়া গণকবর
- জলঢাকা মুন্নু পার্ক ইত্যাদি
উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব
- শাহ কলন্দর - উত্তরাঞ্চলের প্রথম পর্যায়ের ইসলাম প্রচারকদের মধ্যে অন্যতম ব্যক্তিত্ব
- কাজী কাদের - পাকিস্তান আমলের সাবেক মন্ত্রী
- মশিউর রহমান (যাদু মিয়া) - জিয়াউর রহমান সরকারের সময় প্রধানমন্ত্রীর মর্যাদায় সিনিয়র মন্ত্রী
- শহীদ জননী জাহানারা ইমাম - কথাসাহিত্যিক
- খয়রাত হোসেন - সাবেক মৎস ও পশুপালন মন্ত্রী
- মোস্তফা কামাল - সাবেক প্রধান বিচারপতি
- শফিকুল গনি স্বপন - বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি- বাংলাদেশ ন্যাপ'র চেয়ারম্যান
- মহেশ চন্দ্র রায় - উত্তরবঙ্গের বিখ্যাত ভাওয়াইয়া গানের শিল্পী
- মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী - জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব
- হরলাল রায় - ভাওয়াইয়া শিল্পী
- রথীন্দ্রনাথ রায় - ভাওয়াইয়া শিল্পী
- মুক্তিযোদ্ধা জয়নাল আবেদীন - সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড
- আসাদুজ্জামান নূর - নাট্য ব্যক্তিত্ব ও সাবেক সংস্কৃতি মন্ত্রী
- আনিসুল হক - লেখক, নাট্যকার ও সাংবাদিক
- বেবি নাজনিন - কন্ঠশিল্পী
- আতিকুল ইসলাম - ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের বর্তমান মেয়র ইত্যাদি।
