দিনাজপুর জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য
জেলা পরিচিতি (পর্ব-৪): দিনাজপুর
ইতিহাস
দিনাজপুর, বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রংপুর বিভাগের একটি অন্যতম প্রাচীন ও বৃহৎ জেলা। উপজেলার সংখ্যানুসারে দিনাজপুর বাংলাদেশের একটি “এ” শ্রেণীভুক্ত জেলা। উত্তরবঙ্গের ১৬টি জেলার মধ্যে বৃহত্তম এই জেলাটি ভূতাত্ত্বিকভাবে ভারতীয় প্লেটের অংশ যা আদি জুরাসিক যুগে সৃষ্টি হওয়া গন্ডোয়ানাল্যান্ডের অংশ ছিল।
এ জেলার ব্র্যান্ডিং স্লোগান হলো: চাল-লিচুতে ভরপুর জেলার নাম দিনাজপুর।
দিনাজপুর একসময়ে পুণ্ড্রবর্ধনের অংশ ছিল। লক্ষ্ণৌতির রাজধানী দেবকোটের অবস্থান ছিল দিনাজপুর সদরের ১১ মাইল দক্ষিণে। সম্প্রতি ঘোড়াঘাট উপজেলার সুর মসজিদের পাশের পুকুর থেকে গুপ্ত যুগের একটি শিলালিপি পাওয়া গেছে।
অবিভক্ত বাংলার সর্ববৃহৎ জেলা হিসেবে পূর্বে এ জেলা বগুড়া, মালদা, রাজশাহী, রংপুর ও পূর্ণিয়া জেলার বেশকিছু অংশ নিয়ে গঠিত হয়েছিলো।
১৭৮৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া এ জেলার নামকরণ সম্পর্কে যতদূর জানা যায় তা হলো: জনৈক দিনাজ অথবা দিনারাজ দিনাজপুর রাজপরিবারের প্রতিষ্ঠাতা। তার নামানুসারেই রাজবাড়িতে অবস্থিত মৌজার নাম হয় "দিনাজপুর"। পরবর্তীতে ব্রিটিশ শাসকরা ঘোড়াঘাট সরকার বাতিল করে নতুন জেলা গঠন করে এবং রাজার সম্মানে জেলার নামকরণ করে "দিনাজপুর"।
১৮৫৬ সালে দিনাজপুর পৌরসভা প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলার প্রথম দিককার ৪০টি পৌরসভার মধ্যে এটি অন্যতম। আঠারো শতকের শেষ দিকে দিনাজপুরে নীল চাষ শুরু হয়।
ভৌগলিক অবস্থান ও গঠন কাঠামো
দিনাজপুর জেলার উত্তরে ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড় ও নীলফামারী জেলা, দক্ষিণে জয়পুরহাট জেলা ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য, পূর্বে রংপুর ও নীলফামারী জেলা এবং পশ্চিমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর জেলাদ্বয় অবস্থিত।
এই জেলার মোট আয়তন প্রায় ৩৪৩৮ বর্গ কিলোমিটার এবং রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় ৪১৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।
দিনাজপুর জেলায় করতোয়া নদী, ইছামতি নদী এর মত ২৬টিরও বেশি নদী রয়েছে।
প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো
দিনাজপুর জেলায় মোট ১৩টি উপজেলা, ৮টি পৌরসভা ও ৬-১১ পর্যন্ত মোট ৬টি সংসদীয় আসন রয়েছে।
এ জেলার উপজেলাগুলো হলো:
- দিনাজপুর সদর
- বিরামপুর
- খানসামা
- বীরগঞ্জ
- বোচাগঞ্জ
- ফুলবাড়ী
- চিরিরবন্দর
- ঘোড়াঘাট
- হাকিমপুর
- কাহারোল
- নবাবগঞ্জ
- পার্বতীপুর
- বিরল
এর মধ্যে আয়তনের দিক থেকে সবচেয়ে বড় হলো বীরগঞ্জ উপজেলা এবং সবচেয়ে ছোট হলো হাকিমপুর উপজেলা।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান
দিনাজপুর জেলার উল্লেখযোগ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মধ্যে রয়েছে:
- হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
- দিনাজপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট
- দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ
- দিনাজপুর সরকারি কলেজ (১৯৪২),
- দিনাজপুর সরকারি মহিলা কলেজ
- দিনাজপুর সরকারি সিটি কলেজ (১৯৬৬);
- ফুলবাড়ী সরকারি কলেজ (১৯৬৩)
- ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ
- দিনাজপুর জিলা স্কুল
- দিনাজপুর সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় (১৮৬৯),
- ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড উচ্চ বিদ্যালয়
- জামিয়া ইসলামিয়া আজিজিয়া আনওয়ারুল উলুম
- ভবানীপুর ইসলামিয়া কামিল মাদ্রাসা
কৃষি ও সংস্কৃতি
দিনাজপুর জেলায় যেসব আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে তার মধ্যে আছে: সাঁওতাল, ওঁরাও, মাহলী, মালপাহাড়ী, কোল প্রভৃতি ।
দিনাজপুরে মূলত ভাওয়াইয়া, কীর্তন, পাঁচালি, মেয়েলি গীত, গোরক্ষনাথের গান, চড়কের গান, বাউল গান, ধাঁধা, জারিগান এর প্রচলন রয়েছে।
এ জেলার আঞ্চলিকভাবে প্রচলিত খেলার মধ্যে হা-ডু-ডু, গোল্লাছুট, বউ ছি, লুকোচুরি খেলার অন্যতম।
দিনাজপুরকে নিয়ে একটি বাংলা প্রবাদ রয়েছে:
গোলা ভরা ধান
গোয়াল ভরা গরু
পুকুর ভরা মাছ
কৃষিনির্ভর দিনাজপুর জেলার মাশিমপুরের বেদেনা লিচু বিশ্ববিখ্যাত। লিচু ছাড়াও দিনাজপুর জেলা ধান উৎপাদনের জন্যও বিখ্যাত। দিনাজপুরের কাটারিভোগ ও কালিজিরা ধান দেশে-বিদেশে সমাদৃত। সমগ্র বাংলাদেশের চালের চাহিদার একটি বড় অংশ আসে দিনাজপুর থেকে। এছাড়াও দিনাজপুরে প্রচুর গম, ভুট্টা, আলু, বেগুন ও টমেটো উৎপাদিত হয়। ফলের মধ্যে লিচু, আম, কলা, কাঁঠাল ও জাম উৎপাদিত হয়।
বানিজ্য ব্যবস্থা
দিনাজপুর জেলার শিল্পকারখানার মধ্যে সেতাবগঞ্জ চিনি কল লিমিটেড, দিনাজপুর টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড অন্যতম। বাংলাদেশের সর্বপ্রথম যে তেল শোধনাগার স্থাপন করা হয়েছিলো সেটি ছিলো এ জেলার বিরামপুর উপজেলায়।
এ জেলা থেকে বিভিন্ন ধরনের দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হয় যার মধ্যে আছে: দৈনিক তিস্তা, দৈনিক উত্তর বাংলা, দৈনিক আজকের দেশবার্তা, দৈনিক পত্রালাপ ইত্যাদি।
দিনাজপুরে আলোর দিশারী নামে একটি সাক্ষরতার আন্দোলন চালু আছে।
উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব
দিনাজপুর জেলার উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিদের মধ্যে আছেন:
- হাজী মোহাম্মদ দানেশ - অবিভক্ত ব্রিটিশ ভারতের কৃষক নেতা
- প্রেমহরি বর্মন, (**** -১৯৭২) দিনাজপুর জেলা তফশিলী সম্প্রদায়ের নেতা, ব্রিটিশ ভারতের এমপি ও বঙ্গীয় প্রাদেশিক পরিষদের মন্ত্রী
- অধ্যাপক ইউসুফ আলী, ( ১৯২৩ - ১৯৯৯) স্বাধীনতার সনদ পাঠক, মুজিবনগর সরকারের ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী, বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী
- এম আব্দুর রহিম, (২১ নভেম্বর ১৯২৭ - ৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৬) স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, সংবিধান রচনাকারী
- সুভাষ দত্ত, (৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩০ - ১৬ নভেম্বর, ২০১২), বাংলাদেশি চলচ্চিত্রশিল্পী, নির্মাতা ও অভিনেতা
- আব্দুল বারী, (১লা সেপ্টেম্বর, ১৯৩০- ৪ঠা জুন, ২০০৩) বাংলাদেশের দিনাজপুরে জন্মগ্রহণকারী বাংলাদেশী লেখক ও শিক্ষাবিদ
- বিচারপতি এ. টি. এম. আফজাল - (জন্ম: ১ জুন ১৯৩৪) বাংলাদেশের ৮ ম প্রধান বিচারপতি
- নিতুন কুন্ডু - (৩ ডিসেম্বর, ১৯৩৫ - ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০০৬), বাংলাদেশি চিত্রশিল্পী, ভাস্কর
- আবুল হাসান মাহমুদ আলী - (জন্ম: ২ জুন ১৯৪৩) সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী
- খালেদা জিয়া, (জন্ম: আগস্ট ১৫, ১৯৪৫), বাংলাদেশের সাবেক ও প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী
- মাহবুবুর রহমান - বাংলাদেশের সাবেক সেনাপ্রধান ও বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী স্থায়ী কমিটির সদস্য
- ডা. মোহাম্মদ আমজাদ হোসেন - (৫ এপ্রিল, ১৯৫৪- বর্তমান) দেশসেরা অর্থোপেডিক চিকিৎসক
- এ এল এম ফজলুর রহমান - বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা এবং বাংলাদেশ রাইফেলসের সাবেক মহাপরিচালক
- খালিদ মাহমুদ চৌধুরী - নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী
- নাজিব তারেক - (জন্ম: সেপ্টেম্বর ৫, ১৯৭০) একজন বাংলাদেশি চিত্রশিল্পী
- ধীমান ঘোষ - (জন্ম: ২৩ নভেম্বর ১৯৮৭) ক্রিকেটার
- লিটন দাস - (জন্ম: ১৩ অক্টোবর, ১৯৯৪) ক্রিকেটার
- নবীন ইসলাম - (জন্ম ২৫ ডিসেম্বর, ১৯৯৬) ক্রিকেটার
দর্শনীয় স্থানসমূহ
- দিনাজপুর জাদুঘর - যেটি বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম প্রাচীন নিদর্শনের সংগ্রহশালা
- অরুণ ধাপ
- বার পাইকের গড়
- ঘোড়াঘাট দুর্গ
- প্রাচীন বিষ্ণু মন্দির, কাহারোল
- কালিয়া জীউ মন্দির
- রামসাগর দিঘি - যেটি বাংলাদেশে মানবসৃষ্ট সবচেয়ে বড় দিঘি
- মোহনপুর রাবার ড্রাম
- কান্তজিউ মন্দির
- ঘুঘুডাঙ্গা জমিদার বাড়ি
- দিনাজপুর ঈদগাহ ময়দান - বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ঈদগাহ
- দিনাজপুর রাজবাড়ি
- নবাবগঞ্জ জাতীয় উদ্যান
- নয়াবাদ মসজিদ
- পার্বতীপুর রেলওয়ে স্টেশন
- বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি
- বিরামপুর জমিদার বাড়ি
- রখুনি কান্ত জমিদার বাড়ি
- রামসাগর জাতীয় উদ্যান
- সীতাকোট বিহার
- স্বপ্নপুরী
- হিলি স্থলবন্দর
